প্রকাশের সময়: সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৯ পিএম প্রিন্টের তারিখ: বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২

সালাত না আদায় করেও জান্নাতী যে সাহাবী

সালাত না আদায় করেও জান্নাতী যে সাহাবী
শাম্মী আক্তার

শাম্মী আক্তার

বারিশাল বিভাগীয় প্রতিনিধি

যে লোকটি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও; একটি টাকা সাদাকা না করেও জান্নাতুল ফিরদাউসে চলে গেলেন।

চলুন জেনে নেই সে বিস্ময়কর সৌভাগ্যবান ব্যক্তির ঘটনা।

ইসহাক ইবন ইয়াসার বলেন, রাসূল সা. খায়বার অবরোধ করে রেখেছেন। অবরোধ চলাকালে খায়বার শহরের একজন রাখাল ছিলো। যার নাম আসলাম আল আসওয়াদ আল হাবশী রাখাল নামে পরিচিত, তিনি ভাবলেন,এমন সুবিশাল বাহিনী আর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বার আক্রমন করেছেন, গিয়ে একটু জেনে আসি তাঁর আসলে মিশনটা কী? সে কিসের দিকে মানুষকে ডাকে? তাঁর ভিশন-ই বা কী?

রাখাল ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিমবাহিনীর তাঁবুর দিকে অগ্রসর হলো। তাঁবুর কাছাকাছি একজন মুসলমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হলো। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি জানতে চাই তোমরা কেন খায়বারের ওপর আক্রমণ করছো? কোন কারণে আমাদের শহরের বাসিন্দারা তোমাদের দুশমন হলো? তোমাদের মূল দাওয়াত ও পয়গাম কী?

মুসলমান লোকটি ছিলেন একজন সাহাবি । তিনি ইসলামের আকিদা ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে আসওয়াদ রাখালকে বললেন, তুমি বরং আমাদের সরদার আল্লাহর রাসূল (সা.) সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁকেই এ প্রশ্নগুলো কর। তিনিই তোমাকে ইসলামের বুনিয়াদি দাওয়াত ও নেয়ামতের মূল পয়গাম সম্পর্কে বলে দিবেন।

আসওয়াদ রাখালের কাছে এই কথা একদম নতুন ছিল। তাঁর কল্পনায়ও ছিল না যে, কোনো বাহিনীর সিপাহসালার, কোনো ফৌজের বড় অফিসার কিংবা কোনো রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার মত রাখালকে সশরীরে দরবারে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারে।

তাই তিনি বললেন, আমি তোমাদের সরদারের কাছে কীভাবে যাব? তিনি তো তোমাদের রাষ্ট্রের প্রধান। আর আমি সামান্য রাখালমাত্র। উত্তরে সেই সাহাবি বললেন, আমাদের সরদার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গরিবদের প্রতি অত্যন্ত সহমর্মী ও আন্তরিক। তাঁর মজলিসে ধনী ও গরিবের মাঝে, শাসক ও প্রজার মাঝে, নেতা ও কর্মীদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

রাখাল লোকটি খুবই অবাক হলো! নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সামনে অগ্রসর হলেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে ভয়ে ভয়ে দুরুদুরু মনে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আপনার কাছে জানতে চাই আপনার মূল দাওয়াত কী? আপনি কেন এই অঞ্চলে এসেছেন?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে তাকে খুব সংক্ষেপে তাওহিদ সম্পর্কে বুঝালেন। আসওয়াদ রাখাল যখন তাওহিদ সম্পর্কে অবগত হলো, সে জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ এই বিশ্বাস গ্রহণ করে আপনার সঙ্গে শামিল হয়ে যায়, তা হলে তার কী লাভ হবে? তিনি বললেন, যদি তুমি এই বিশ্বাস গ্রহণ করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নাও তাহলে তুমি আমাদের ভাই হয়ে যাবে। তোমাকে আমরা আমাদের বুকে জড়িয়ে নিব। সকল মুসলমান যেসব অধিকার পায় তুমিও তা পাবে।

আসওয়াদ রাখাল অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কীভাবে সেসব অধিকার পাবো অথচ আমি একজন সামান্য রাখাল? আমার রঙ কালো। আমি কুৎসিত চেহারার অধিকারী। আমার দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। আমার শরীরে ময়লা জমে থাকে। এই অবস্থায় আপনারা আমাকে কীভাবে বুকে জড়িয়ে নিবেন? কীভাবে আমাকে আপনাদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করবেন?

 

নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আশ্বস্ত করলেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি এমনই হবে তা হলে আমি তাওহিদ ও একত্ববাদের ওপর ইমান আনব। আচ্ছা, আমাকে বলুন তো দেখি, আমার কৃষ্ণবর্ণ, কুৎসিত চেহারা, আমার দেহের ময়লা ও দুর্গন্ধের কী প্রতিকার হবে?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

আমি এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, যদি তুমি তাওহিদের ওপর ইমান আন তা হলে দুনিয়ায় তোমার কুৎসিত চেহারা ও কৃষ্ণবর্ণের প্রতিকার না হলেও, যখন তুমি পরকালে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, তখন তোমার চেহারা শুভ্রোজ্জ্বল ও আলোকিত হবে। আল্লাহ তোমার চেহারার কালো রঙ নুর দ্বারা বদলে দিবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন করে দিবেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি তা-ই হবে তা হলে আমি ইসলাম কবুল করলাম, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।

লোকটি ইসলাম গ্রহণের পর বলেনঃ আমি এই ছাগলগুলির মালিকের মজুর। আমার নিকট এগুলি তার আমানত। এখন এ ছাগলগুলি আমি কি করবো ?

রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ

তুমি এগুলির মুখে একটু আঘাত করে মালিকের বাড়ির দিকে ছেড়ে দাও, তারা মালিকের কাছে ফিরে যাবে।

কালো লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একমুঠ ধুলোবালি উঠিয়ে ছাগলগুলির মুখের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বললেনঃ তোমরা তোমাদের মালিকের নিকট ফিরে যাও, আল্লাহ তোমাদের সাথে থাকবেন। ছাগলগুলি দলবদ্ধভাবে ফিরে গিয়ে সেই দুর্গে ঢুকলো, যেন কোন রাখাল তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে।

এরপর রাখাল লোকটি জিজ্ঞাসা করল, বলুন, এবার আমার দায়িত্ব কী? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলামে বহু ফরজ বিধান রয়েছে। তবে এখন নামাজের সময় না। রোজার মাসও না। তোমার ওপর জাকাতও ফরজ হয়নি। এখন হজের মওসুমও না। তাই তোমাকে নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত কোনোটিই পালনের নির্দেশ দিতে পারি না। এখন তুমি একটি ইবাদতই করতে পার, তা হলো খায়বারের রণাঙ্গনে হক ও বাতিলের লড়াই চলছে, আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তাদের প্রাণকে উৎসর্গ করছেন। এই মুহূর্তে তোমার দায়িত্ব হলো জিহাদে শামিল হয়ে যাওয়া।

আসওয়াদ রাখাল বলল, আমি যদি এই যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাই তা হলে আমার প্রতিদান কী হবে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে এ বিষয়ের জামানত দিচ্ছি যে, যদি তুমি এ জিহাদে শহিদ হয়ে যাও, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে দিবেন। তোমার চেহারা উজ্জ্বল করে দিবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধি দিয়ে বদলে দিবেন।

আসওয়াদ রাখাল রাসূল সা. এর কথায় পূর্ণ আস্হাশীল যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন। দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষয়ী লড়ায়ের পর যুদ্ধ শেষ হলো। খায়বার মুসলমানদের করাগত হয়ে গেলো।

যুদ্ধে সেই কালো লোকটি দুর্গ ঘেরাওকারী মুসলিমদের লক্ষ্য করে শত্রু বাহিনীর নিক্ষিপ্ত একটি পাথরের আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করারও সুযোগ তিনি পাননি।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহিদদের লাশ দেখার জন্য বের হলেন। শহিদদের লাশের মাঝে আসওয়াদ রাখালের লাশটিও পড়ে ছিল। যখন লাশটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আনা হলো, তাঁর মোবারক চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। তিনি বললেন, ইনি এক আশ্চর্য ব্যক্তি। এমন একব্যক্তি, যিনি আল্লাহর জন্য একটি সেজদাও করেননি। আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও খরচ করেননি। আল্লাহর জন্য অন্য কোনো ইবাদত করার সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে গিয়েছেন। আমি দেখছি, আল্লাহ তায়ালা তার চেহারার কৃষ্ণবর্ণকে নুর দ্বারা বদলে দিয়েছেন। তার দেহের দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জা সুগন্ধি দ্বারা সুরভিত করে দিয়েছেন।

অন্য আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়-

তাঁর মৃতদেহটি এনে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পিছনে রেখে তাঁর মাথায় থাকা পাগড়িটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর দিকে তাকালেন। তখন তাঁর পাশে কয়েকজন সাহাবীও ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) খুব দ্রুত মৃতদেহটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

সাহাবায়ে কিরাম (রা) জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন কেন? তিনি বললেনঃ তার সাথে রয়েছে তার স্ত্রী-ডাগরচক্ষু বিশিষ্ট হুর। অর্থাৎ তিনি জান্নাতে পৌঁছে গেছেন এবং ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুরদের সাথে অবস্থান করছেন। আল্লাহু আকবার!

প্রকাশক : সৈয়দ মাহমুদ মূসা

অফিস এড্রেস :3/1 , Block F , Lalmatia, Dhaka

+8801779338880‬

info@studentbd24.news (সাধারণ তথ্যের জন্য), editor@studentbd24.news (সম্পাদকীয়),

প্রিন্ট করুন